রফতানি খাতকে চাঙ্গা করতে নগদ সহায়তার ওপর আরোপিত উৎসে কর কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া হ্রাসকৃত হারে উৎসে কর আদায়ে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল এবং রফতানি বিল অব এক্সচেঞ্জের ওপর স্ট্যাম্প ডিউটি বাতিলেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) পোশাক রফতানি হয়েছে ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের। যদিও লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ২০২ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় তো বটেই, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায়ও সাড়ে ৬ শতাংশের বেশি কমেছে তৈরি পোশাকের রফতানি।
জানা গেছে রফতানি আয়ের ধীরগতির কারণ খুঁজতে এবং তৈরি পোশাক বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে দায়িত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ নভেম্বর বাণিজ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সচিবালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, অর্থ সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক, এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ও সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিনসহ পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা অংশ নেন। ওই সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আয়কর অধ্যাদেশে রফতানি আয়ের বিপরীতে উৎসে কর ১ শতাংশ ধার্য করা আছে। প্রতি বছর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই উৎসে কর কমানো হয়ে থাকে। গতবারের মতো এবারও প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে উৎসে কর হার কমিয়ে দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। তবে এ বছর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় ২১ অক্টোবর এবং সেদিন থেকেই প্রজ্ঞাপন কার্যকর করা হয়। অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত রফতানি আয়ের বিপরীতে রফতানিকারকদের ১ শতাংশ হারেই কর দিতে হবে। অন্যদিকে চলতি বাজেটে নগদ প্রণোদনার বিপরীতে উৎসে কর ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
সভায় বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, পণ্যের দরপতন ও প্রচলিত পণ্যের মূল্য রফতানি হ্রাস পেলেও ম্যান মেইড ফেব্রিক্সের জ্যাকেটের রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রচলিত রফতানিযোগ্য পণ্যের রফতানি বাড়ছে না। বাংলাদেশের তুলনায় প্রতিযোগী দেশ পাকিস্তান, ভারত, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, চীন ও শ্রীলংকা ডলারের বিপরীতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। এছাড়া অন্য প্রণোদনা ছাড়াও ভিয়েতনাম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করেছে। এ কারণে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্য বিরোধের সুবিধা বাংলাদেশ নিতে পারছে না। বেশিরভাগ ব্যবসাই ভিয়েতনামে চলে যাচ্ছে। ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে উন্নতি হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক কম।
তৈরি পোশাক খাতের উন্নয়নে ৬টি প্রস্তাব দেন বিজিএমইএ সভাপতি। এগুলো হচ্ছে- হ্রাসকৃত উৎসে কর প্রজ্ঞাপন ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা রফতানির বিপরীতে নগদ সহায়তার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর প্রত্যাহার, ১৩৩টি রুগ্ন পোশাক কারখানার সব ধরনের ব্যাংক ঋণ মওকুফ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পোশাক কারখানার ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বৃদ্ধি, তৈরি পোশাকের পণ্য বহুমুখীকরণের বিশেষ প্রণোদনা দেয়া এবং ম্যান মেইড ফাইবার উৎপাদনে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া পোশাক রফতানিকারকদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে পণ্যের মূল্য কমানো থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে বলেন, পণ্যের মূল্য কমিয়ে দেয়া থেকে সবাই একযোগে বিরত থাকা যায় সে বিষয়ে কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। ভারত, চীন, ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্র কম শুল্কে পণ্য আমদানির অনুমতি দিলেও বাংলাদেশকে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) দেশ হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ শুল্ক দিতে হচ্ছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি ব্যাহত হচ্ছে। সভায় পোশাক খাতের সমস্যাগুলো প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দেন তিনি।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বন্দর অব্যবস্থাপনা, কাস্টমসের অসহযোগিতার কারণে ক্রেতারা ভিয়েতনাম, চীন থেকে পণ্য কিনছেন। মূলত অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়ায় কর্মকর্তারা জোর করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের চেষ্টা চালান। পণ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে আগাম তদন্ত রিপোর্টের নামে হয়রানি বন্ধে এনবিআর চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পণ্য আমদানিকারকদের তালিকা করে তাদের সুবিধা দেয়া হবে।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও বর্তমান এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একাধিকবার কর আদায় যৌক্তিক নয়। গত ১০ বছরে পোশাক শ্রমিকদের বেতন প্রায় ৪৮১ শতাংশ বেড়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী পোশাক শিল্পে প্রণোদনা বাড়েনি। প্রতিযোগী দেশগুলো পোশাক শিল্পে কী ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে তা বিশ্লেষণ করে দেশের প্রণোদনা নির্ধারণ এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক ঋণের সুদ হার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।
এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এনবিআর নগদ সহায়তার উৎসে কর কমানোর বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। কর হার কত হবে সে বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অর্থমন্ত্রী নির্দেশনা দেবেন। তাদের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এছাড়া রফতানির বিপরীতে উৎসে কর হারের প্রজ্ঞাপন সংশোধনেও কাজ চলছে।
শেয়ারবার্তা / আনিস