২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের শেয়ারবাজার শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বিনিয়োগকারীদের আশাবাদের মধ্য দিয়ে। শুরুর দিকে কিছুটা উত্থান দেখা গেলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাজার দ্রুত নিম্নমুখী প্রবণতায় চলে যায়। বছর শেষে ডিএসইর সূচক ৯ শতাংশের বেশি কমে যায়, যার ফলে বাজার মূলধন থেকে অন্তত ৩৩ হাজার কোটি টাকা হারিয়ে যায় এবং বিপুল সংখ্যক বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়ে যান।
তবু বাজার বিশ্লেষকরা আশাবাদী, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। তাদের মতে, সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং বাস্তবভিত্তিক সংস্কারই বাজারকে পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে নিতে পারে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এই অর্থবছর শেষ করেছে এর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স-এ ৯.৯১ শতাংশ পতনের মধ্য দিয়ে, যা ৪ হাজার ৮৩৮ পয়েন্টে ক্লোজ হয়েছে। অন্যদিকে, ব্লু-চিপ সূচক (ডিএস৩০) ৪.৯২ শতাংশ কমে ১ হাজার ৮১৬ পয়েন্টে নেমে এসেছে। ডিএসই-এর তথ্য অনুযায়ী, একই সময়ে শেয়ারের বাজার মূলধন ৩৩ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা কমেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) এর তথ্য অনুযায়ী, শেয়ার ব্যালেন্স থাকা বেনিফিশিয়ারি ওনার (বিও) অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৬১৯ কমেছে, যা নির্দেশ করে অনেক হতাশ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দীর্ঘদিনের সুশাসন, স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুনর্গঠনের সরকারি উদ্যোগের পর বিএসইসি ২০২৫ অর্থবছরে শেয়ারবাজারে বেশ কিছু বড় সংস্কার এনেছে। নতুন কমিশন নিয়োগের পর অন্তর্বর্তী সরকার তাদের বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং বাজারে আরও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় নতুন বিএসইসি নেতৃত্ব শেয়ারবাজারে আলোচিত অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তের জন্য বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটিগুলো ইতিমধ্যেই ১২টি প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে, যা বর্তমানে প্রয়োগাধীন রয়েছে।
এছাড়াও, কৌশলগত সংস্কারের উন্নয়নে ও বাস্তবায়নে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্ক ফোর্স এ পর্যন্ত পাঁচটি মূল প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যার মধ্যে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও), মিউচুয়াল ফান্ড এবং মার্জিন ঋণ নীতিমালা সংস্কারের সুপারিশ রয়েছে। এই প্রতিবেদনগুলো শেয়ারবাজারের কার্যক্রম উন্নত করার জন্য একটি রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এত চেষ্টা সত্ত্বেও এই সময়ে প্রাথমিক বাজার মূলত নিষ্ক্রিয় ছিল এবং তহবিল প্রবাহ স্থবির ছিল। কোনো কোম্পানি আইপিও, রাইটস অফার বা প্রেফারেন্স শেয়ারের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করেনি। উপরন্তু আইপিও, রাইটস ইস্যু এবং প্রেফারেন্স শেয়ারের জন্য বেশ কয়েকটি আবেদন নতুন কমিশন দ্বারা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
তবে কমিশন বেশ কিছু বিনিয়োগকারী-বান্ধব ব্যবস্থা চালু করেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে, বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার) অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণ ফি ৪৫০ টাকা থেকে কমিয়ে ১৫০ টাকা করা হয়েছে, যা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের খরচ কমিয়েছে।
ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) মার্জিন অ্যাকাউন্টে নেতিবাচক ইক্যুইটি পরিস্থিতি সমন্বয়ের সময়সীমা বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, মৌলিকভাবে ভালো কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তি ত্বরান্বিত করতে নতুন করে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ৩০ কোটি টাকার ন্যূনতম পরিশোধিত মূলধনের শর্ত কার্যকর করা হয়েছে, যার আওতায় ইতিমধ্যে ৬০টি তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে নোটিশ ইস্যু করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনায়, বাজারে বৈচিত্র্য আনতে এবং মানসম্পন্ন কোম্পানি আনতে বিএসইসি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি কমিটি গঠনে ভূমিকা পালন করছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানি এবং শক্তিশালী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাভুক্তির পথ সুগম হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিএসইসি’র পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম জানান, বর্তমান কমিশন শেয়ারবাজার সংস্কারে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরমধ্যে তদন্ত কমিটিগুলো ১২টি এবং টাস্ক ফোর্স ৫টি প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিয়েছে। অন্যান্য কাঠামোগত সংস্কার এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা ধাপে ধাপে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শেয়ারবাজারে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও আস্থা ফিরবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।